
প্রকাশিত: Wed, Dec 21, 2022 4:15 AM আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 12:27 PM
জাদুকর মেসির নেতৃত্ব এবং ডক্টর স্কালোনি!
মনজুরুল হক
বিতর্কিত বিটে প্রশ্নবিদ্ধ ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে। দোহার একটা কুৎসিত কংক্রিট জঞ্জালে অনুষ্ঠিত ফাইনাল শেষে ফুটবলের যাদুকর লিওনেল মেসির নেতৃত্বে এবং তার শতভাগ উজাড় করে দেওয়া টুর্নামেন্টের ফাইনালে ফুটবলের মুকুটহীন সম্রাট দিয়েগো ম্যারাডোনার স্বপ্নের সারথীরা ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ হাতে তুলেছে। প্রথম ম্যাচে অভাবনীয় হোচট খাওয়ার পর দাঁতে দাঁত চেপে ঘুরে দাঁড়িয়ে ‘নেভার সে ডাই’ মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে শত শত প্রশ্নের জবাব দিয়েছে টিম আর্জেন্টিনা। ভামোস আলবিসেলেস্তে। নটে গাছটি মুড়িয়েছে। তারপরও এই লেখা কেন? তেমন কিছু নয়, একটু ফিরে দেখা।
যেমনটা ভাবা হয়েছিল; লিওনেল স্কালোনি তাই করেছেন। টানা দুই ম্যাচে একই ফর্মেট রাখেননি। ফাইনালে তিনি ৪-৪-২ ফর্মেটে টিম নামালেন। স্পষ্টতই রক্ষণাত্মক কৌশল। এরই মধ্যে তিনি ফিরিয়ে আনলেন ‘উইথ দ্য বল’ স্ট্রাটিজি, যেটা পোল্যান্ডের সঙ্গে এ্যাপ্লাই করেছিলেন। নো কাউন্টার এ্যাটাক। নো স্পেস গিভ টু দ্য অপোনেন্ট। মাঝে মাঠের দখল নিয়ে দুই উইং দিয়ে আক্রমণ। বিশেষ করে লেফট উইং দিয়ে, কেননা সেখানে আছেন ডি মারিয়া। এই সময়ে বলের ওপর তার দখল এতটাই যে তিন-চার জন ডিফেন্ডারও আটকাতে পারে না। স্কালোনি জানতেন ফ্রান্সের তীব্র গতি আর দুই স্ট্রাইকারের স্কিলকে কোনোভাবেও হালকা ভাবে নেয়া যাবে না। তাই মাঝ মাঠের যোগানদাতা গ্রিজম্যানকে একরকম অকেজো করে পুরো খেলা নিজেদের গ্রিপে নিয়েছিল আর্জেন্টিনা।
২৩ মিনিটে মেসির টোকা থেকে বল পেলেন ডি মারিয়া। তিনি নিখুঁতভাবে গোল লাইনে ঢুকে পড়েছিলেন। পেছন থেকে ফাউল হলো। প্যানাল্টি। মেসি ঠাণ্ডা মাথায় বল জালে জড়ালেন। ৩৬ মিনিটে ওই মেসির বাড়ানো বল আড়াআড়ি আগুয়ান ডি মারিয়াকে পাঠান এ্যালিয়েস্টার। ওয়ান টাচে ডি মারিয়া কিপারের মাথার উপর দিলে জালে জড়ালেন। ৪১ মিনিটে থুরামের বল মিস করলে জিরাড। একটু পরেই কুলো মুয়ানির বাড়ানো বল মিস করলেন ডেমবেলে। প্রথম অর্ধে এই এতোটুকুই ফ্রান্সের কৃতিত্ব। তা বাদে ৭৯ মিনিট পর্যন্ত আর্জেন্টিনার বল প্রসেসিং ৭০ শতাংশ। দেখা গেলো মাঝ মাঠে তো বটেই, স্ট্রাইক ডিফেন্ডারের পায়ের বলটাও কেড়ে নেয়ার জন্য দুজন আর্জেন্টাইন ছুটছেন। মাঠের কোথাও ফ্রান্সের প্লেয়াররা একটা সেকেন্ড সময় পায়নি বল পায়ে কী করবেন সেটা ভাবতে। এই প্রায় একতরফা ম্যাচে কীভাবে ফিরে আসল ফ্রান্স?
সেকেন্ড হাফের ৬৪ মিনিটে একুইনার থ্রু পাস ধরে স্কোর করতে পারলেন না ডি মারিয়া। এর পর পরই ধীরে ধীরে ফ্রান্স খেলায় ফিরতে থাকল। ৭১ মিনিটে কোমানের দেয়া বল যখন গ্রিজম্যান দখলে রাখতে পারলেন না তখন দেশাম তাকে তুলে নিলেন। ওই ৭১ মিনিটেই ক্যাম্বিনেজের একটা চমৎকার পাস ধরতে পারলেন না হার্নান্দেজ। ৮০ মিনিটে হার্নান্দেজ আর ফোফানার যৌথ আক্রমণ লেফট উইং দিয়ে। মুয়ানিকে ফাউল করে বসলেন ওটামেন্ডি। কারণ সে ছাড়া আর কেউ ছিল না ডিফেন্স লাইনে। ওটামেন্ডি বাধ্য হয়ে পেছন থেকে ধাক্কা দিলেন। ফলাফল-পেনাল্টি। তীব্র শটে গোল করলেন এমবাপ্পে। এর ৭০/৭৫ সেকেন্ড পরই একটা বল মেসি আর কুন্ডে দখলে নিতে গেলে সেই বলটা মেসিকে ফাউল করে কেড়ে নিয়েছিল কুন্ডে। সেখান থেকে ডামবেলে হয়ে হার্নান্দেজ হয়ে বা- পাশে দাঁড়ানো এমবাপ্পেকে আড়াআড়ি বাড়ালে এমবাপ্পে সাইড ভলিতে দুর্দান্ত গোল করেন। মেসি এবং সতীর্থরা ভেবেছিলেন এটা ফাউল হবে। তাই কয়েক সেকেন্ডের শিথিলতা। ওইটুকু সময়ই দরকার ছিল ওদের। ফলাফল ২-২।
৯১ মিনিটে মন্টিয়েল, ১০২ মিনিটে প্যারিডেস এবং মার্টিনেজের মিস। মেসি রাইট উইং থেকে নিখুঁত মাইনাস করেছিলেন। লাউতারো মার্টিনেজ যাকে ডি মারিয়ার বদলে নামানো হলো সে একটা খেলো মিস করলো। তার বডি ছিল সাইড লাইন মুখি। বল আসছে রাইট উইং থেকে। সে বডি কার্ভ না করেই ফ্রন্ট হেড করল। স্বভাবতই বল সেকেন্ড বারের অনেক বাইরে। ১০৮ মিনিটে ফার্নান্দেজ, ডিপল আর অ্যালিয়েস্টারের যৌথ প্রচেষ্টায় রাইট উইং থেকে বল পান মেসি। প্রথম শট আটকে দেন লরিস। ফিরতি বলে টোকা দিয়ে ম্যাচের তৃতীয় এবং তার দ্বিতীয় গোল করেন। এ সময় সারা বিশ্ব ধরেই নিয়েছিল-ম্যাচ শেষ। কিন্তু ফুটবল বিশ্ব আর নেপথ্য বিশ্বের ভাবনা ছিল অন্যরকম। আর্জেন্টিনাকে দেওয়া প্রথম পেনাল্টি খানিকটা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলে পোলিশ রেফারির মন খুত খুত করছিল হয়তো। তাই ব্যালান্স করার জন্য আনইন্টেনশনাল হ্যান্ডবল যে বলটা ফ্রান্সের শট ছিল গোলে, সেটা জটলায় এ্যালিয়েস্টারের কনুইতে লেগে যায়।
রেফারি নির্দ্বিধায় পেনাল্টি দিয়ে দেন। এমবাপ্পের হ্যাটট্রিক। ফলাফল-৩-৩!
এর পরের ঘঠনাবলি রেগুলারেশন টাইপ। টাইব্রেকার শুরুর মাত্র ২ মিনিট আগে অর্থাৎ সেকেন্ড এক্সট্রা টাইমে পেনাল্টি স্পটের একটু পেছন থেকে বল পেয়ে মেসির নেওয়া তীব্র স্ক্রুপ শট আটকে দেন লরিস। ওই বলটা একট ু সরে-নড়ে গেলে ম্যাচ ওখানেই শেষ হয়ে যেতো। ওই টেন্সড মোমেন্টে মেসির ঠাণ্ডা মাথার শটটা গোল না হলেও তারা ফাইনাল জিতেছে। তা না হলে এই সব ছোট ছোট ঘটনাগুলো এতটাই বড় হয়ে উঠত যে সারাটা জীবন ধরে গ্লানি বয়ে বেড়াতে হতো ওটামেন্ডি, অ্যালিয়েস্টারকে। এর কিছুক্ষণ পরেই অর্থাৎ খেলা শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে কুলা মুয়ানির শট অ্যাক্রোবেটিক কায়দায় শুয়ে পড়ে বা পায়ে সেভ করেন এমি মার্টিনেজ। ওই সেভটা সম্ভবত এই টুর্নামেন্টের সেরা সেভ। কারণ অমন ক্রুশিয়াল মুহূর্তে একেবার শেষ কয়েক সেকেন্ডে গোলটা হয়ে গেলে কে কাকে দোষারোপ করতো? টাইব্রেকারে গোল সেভ করার ঘটনাটাও তো ঘটত না। তাই এই স্নায়ুক্ষয়কারী ফাইনাল ম্যাচের মোস্ট হার্টব্রেকিং মোমেন্ট কোনটা প্রশ্নের উত্তরে বলে দেওয়া যায়Ñএমি মার্টিনেজ এর লাস্ট সেভ। ইট ওয়াজ আ নেইল বাইটিং মোমেন্ট। ইট ওয়াজ আ হার্টবিট স্টপিং মোমেন্ট। ইটস আ মোমেন্ট অব এমি মার্টিনেজ, দ্য ম্যাজিক্যাল ম্যাজিশয়ান অব দ্য ফুটবল প্লানেট।
শেষে একটা আফসোস থেকেই গেলো। ২-০তে এগিয়ে থাকা অবস্থায় ম্যাচ শেষ হলে গোল্ডেন বুট মেসির থাকে। ওটামেন্ডি ওই ভুলটা না করলে এমবাপ্পেও হ্যাটট্রিক করে না। মেসিও বঞ্চিত হয় না। যদিও এমি এমবাপ্পের প্রথম দুটো গোলের শটেই হাত লাগিয়েছিলো, কিন্তু গতির কাছে আঙ্গুল পরাজিত হয়েছে। এই রূপকথার নেপথ্য কারিগর লিওনেল স্কালোনির কথা অন্য একদিন বলা যাবে। আজ শুধু এতোটুকুই বলে রাখিÑঠাণ্ডা মাথার স্কালোনি সেকেন্ড এক্সট্রা টাইমের লাস্ট ৫ সেকেন্ডে একটা রিপ্লেস করেছিলেন। কে? দিবালা।
কেন, তাকে কি গোল করানোর জন্য নামিয়েছেলন? সময় কই? না। স্কালোনি তাকে নামিয়েছিলেন পেনাল্টি স্পেশালিস্ট হিসাবে। এই চকলেট বয় এবার কোনো ম্যাচেই ২০ মিনিট খেলার সুযোগ পাননি। সেই তাকে নামালেন এবং সে প্রতিদানও দিলেন ঠাণ্ডা মাথায় পেনাল্টি স্কোর করে। দিস ওয়াজ ডক্টর লিওনেল স্কালোনি, দ্য ইয়ংগেস্ট ম্যানেজার অব দ্য টুর্নামেন্ট। শেষ খবরঃ স্কালোনি ঘোষণা করেছেন-তার ছেলেরা ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ দলে মেসির জন্য আসন সংরক্ষিত রাখবে। বাকিটা লিওনেল মেসির উপর। লেখক ও ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
